শিরোনাম
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় হাইতির চেয়ে কম ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র জয় দিয়ে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু বাংলাদেশের হাঙ্গেরিকে ইউরোপীয় আদালতের ২০০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা পদত্যাগ করলেন মোদী, শপথ নিতে পারেন শনিবার সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড যে গ্রামের বাসিন্দারা প্লেনে চড়েই অফিস-বাজারে যান! টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ইমদাদুল হক মিলন ও মাহবুব ময়ূখ রিশাদ বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর মিয়ানমারের সিত্তে শহরের আশপাশের গ্রাম খালি করার নির্দেশ নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 2 March, 2018 21:40
ছোটগল্প

আপন সুর - মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

আপন সুর - মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

রাজধানীর একটি বিলাসবহুল বাড়ির বাসিন্দা সুলতান মাহমুদ। বয়স ৬১ বছর। শরীরে বয়সের স্পর্শ নেই। চলনে-বলনেও নেই বয়সের ছাপ। বড়জোর পঁয়তাল্লিশ অনুমান করা যেতে পারে। সুরুচিবান সুলতান সাহেব দুই বছর হলো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন ছেলের সাথে থাকেন। বই পড়ে, গান শুনে আর ছবি এঁকে অলস সময় পার করছেন। কোনো কিছুর অভাব নেই তার। যখন যেটা প্রয়োজন তা এনে হাজির করছে ছেলে রুপম।

 

নিজের সাজানো-গোছানো আলাদা রুম। সামনে ব্যালকনি। ব্যালকনিতে বসলে রমনা পার্ক দেখা যায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসে। এই পরিবেশ ভালো লাগে সুলতানের। রাজধানী শহরে এমন পরিবেশ পাওয়া মুশকিল। পড়ন্ত বিকেল, উদাস দুপুর কিংবা নিশুতরাতে এখানে বসলে সে কিছুটা হলেও নিজের ফেলে আসা গ্রামের কথা স্মরণ করতে পারে। হারিয়ে যায় স্মৃতির রাজ্যে। তাকে হাতছানি দেয় খালের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছ, ভর দুপুরে বাঁশ পাতার আওয়াজ তাকে মাতাল করে তোলে। সে শুনতে পায় শর্ষে ফুলের ডাক। পূর্ণিমার রাতে ফাঁকা মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা জোছনা তার সকল চিন্তাভাবনা এলোমেলো করে দেয়। তখন ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করে। শোনে একবার যেতে দে না আমার ছোট সোনার গাঁয় কিংবা গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ। প্রকৃতি আর গানের সুর একাকার হয়ে যায়।

 

ব্যক্তিত্বের সাথে চমৎকার তার গানের রুচি। সংগ্রহে আছে হারিয়ে যেতে বসা হাজারো গান। সময় পেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। এ গান অন্য কারো জন্য নয়। নিজের জন্য, নিজের ভালো লাগার জন্য। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এই গান তাকে কিছুই দেয়নি। আবার গানই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনকে মিশিয়ে ফেলেছেন গানের সাথে। ৩৩ বছর বয়সে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে গানের সঙ্গে সংসার পেতেছে। 
মাহমুদের নাতি শৈবাল। বয়স ১০। চমৎকার গানের গলা। এই বয়সে সে অনেক সুনাম কুড়িয়েছে। গত বছর একটি টিভি চ্যানেলে গান প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। শুক্রবারে হলে নাতিকে নিয়ে বসেন মাহমুদ। হারিয়ে যেতে বসা গানগুলো যত্ন করে শেখায় শৈবালকে। বুঝিয়ে দেন গানের অর্থ। শৈবাল ষোলো আনা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে। কিছুদিন আগে মাহমুদের বাল্যবন্ধু রুপাই শৈবালের মুখে সর্বনাশা পদ্মা নদী গান শুনে বলেছে তুই যা পারিসনি নাতি তা করে দেখাবে। এক্কেবারে দাদার হরমোন পেয়েছে। 

 

ইদানীং শৈবালের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সে বাংলা গানের ধারে-কাছেও আসছে না। শুক্রবার হলেই বাইশ-তেইশ বছরের এক লম্বা চুলওয়ালা টিচার এসে ইংরেজি গানের তালিম দিচ্ছে। পাশাপাশি চলছে ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি মেশানো ব্যান্ডের চর্চা। আর তাতে উৎসাহ দিচ্ছে শৈবালের মা-বাবা। এসব ভালো লাগে না সুলতান সাহেবের। সংস্কৃতির অপমৃত্যু দেখে তার কষ্ট হয়। সে ভাবে এ রকম চলতে থাকলে তো একদিন সংস্কৃতির বারোটা বেজে যাবে। ভাবে শৈবালরাই একদিন দেশের হাল ধরবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সঙ্গীতের বড় বড় আসনে বসবে এরাই। অথচ এদের মধ্যে যদি নিজ সংস্কৃতি লালন না করা হয় তবে তারা আগামী প্রজন্মকে কিছুই দিতে পারবে না। এক প্রজন্ম আর এক প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছে না দিলে একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বাংলার লোকসঙ্গীত, বাংলার হাছন, লালন, রাধা-রমনের গান। হারিয়ে যাবে মাঝির মুখে ভাটিয়ালী কিংবা গাড়িয়াল ভাইয়ের মুখের গানগুলো। হারিয়ে যাবে আসল বাঙালি জীবন বাংলা সংস্কৃতি।

 
সামনে বসন্ত উৎসব। ইতিমধ্যে কয়েক জায়গা থেকে গান গাওয়ার ডাক পেয়েছে শৈবাল। সুলতান সাহেব নাতিকে সেভাবে তৈরি করতে চান। কারণ শৈবালের মাঝেই তিনি নিজের শৈশব খুঁজে পান। শৈবাল যখন গান করে মনে হয় নিজের কণ্ঠ থেকে, নিজের হৃদয় থেকে এ সুর বের হচ্ছে। খাঁটি বাংলা সুর। যা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। এবারের বসন্ত মেলাতে শৈবালকে দিয়ে কিছু মাটির গান করাবেন তিনি। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। গানের টিচার তাকে দিয়ে ভিনদেশি সঙ্গীত চর্চা করাচ্ছেন। পাশিপাশি যে সকল বাংলা গান চর্চা করাচ্ছেন তার কোনো অর্থ তাল, লয় ও কথা কিছুই বুঝতে পারেন না সুলতান। এখন কারা গান লিখে আর কারা এর সুর করে মিলাতে গিয়ে তালগোল পাঁকিয়ে ফেলেন সুলতান সাহেব। তিনি ভাবেন অন্তত কয়েকটা দিনের জন্য এ গানের টিচারকে ছুটি দিতে হবে। যে ভাবনা সেই কাজ। তিনি টিচার ডেকে নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন। দুইদিন রক্ষা পাওয়া গেলেও তৃতীয় দিনে আবার এসে হাজির হলেন শৈবালের গানের টিচার। এটা শৈবালের বাবা-মায়ের ইচ্ছে। প্রতিযোগিতার এ যুগে সেকেলে হয়ে থাকার কোনো অর্থ হতে পারে না। সুলতানের মন ভেঙে যায়। ভাবে এভাবেই একদিন দেশীয় সংস্কৃতির ছুটি হবে। তার কিছুই করার নেই। সে এখন নিজ গৃহে পরবাসী। 


আজ বসন্ত উৎসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বকুলতলায় অনুষ্ঠান। শৈবালকে নিয়ে তার বাবা-মা বের হয়ে গেছে। অন্যবার  নিজেই শৈবালের সঙ্গে যায় সুলতান। কিন্তু এবার নিজের ইচ্ছেতেই বাসায় রয়ে গেছেন। কিন্তু ঘরে তার মন টিকছে না। সে সংস্কৃতিপাগল মানুষ। এসব দিনে তার ঘরে থাকার উপায় নেই। সংস্কৃতি যাকে মন থেকে টানে কৃত্রিমতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। বাসা তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে পড়েন সুলতান। উদ্দেশ্য বকুলতলা। শৈবালের গান শোনা। 


বকুলতলায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তরুণ-তরুণীরা বসন্তের পোশাক পরেছে। হলুদ পোশাকের সঙ্গে মাথায় হলুদ ফুল। দেখতে সুন্দর লাগছে। বসন্ত ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে সকলের মনেও বসন্ত। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়ান সুলতান সাহেব। তার চোখ আটকে যায় গানের ভিন্নদেশি যন্ত্রপাতি দেখে। তেরো-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে গান গাচ্ছে বসন্ত বাতাসে গো বসন্ত বাতাসে। মেয়েটির ভরাট কণ্ঠ ভালো লাগে সুলতানের। সে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে মিউজিক দিয়ে গানটাকে নষ্ট করা হয়েছে। তার ভালো লাগার ছন্দপতন ঘটে। সে আনমনা হয়ে যায়। 


শৈবালের কণ্ঠ শুনে বাস্তবে ফিরে আসেন শৈবাল সাহেব। বাংলা-হিন্দি মিলানো একটি গান শুরু করেছে শৈবাল। গানের প্রথম অন্তরা শেষ হতে না হতেই দর্শক সারি থেকে একদল ছেলে ভুয়া ভুয়া চিৎকার করতে শুরু করল। গান শেষে মিলল না কোনো হাততালি। উপস্থাপক আবারো শৈবালের নাম ঘোষণা করলেন। ওস্তাদের শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়ালেন শৈবাল। বললেন আমার গান কি আপনাদের ভালো লাগছে না? দর্শক সারি থেকে আবারো ভুয়া ভুয়া চিৎকার শুনতে পাওয়া গেল। এরাব পরিকল্পনা পরিবর্তন করে কারো আপন হতে পারলি না অন্তর গানটি শুরু করল শৈবাল। সঙ্গে সঙ্গে পিনপতন নীরবতা। গান শেষ হওয়ার পর ওয়ান মোর ওয়ান মোর শব্দ শোনা গেল। পরপর আরো কয়েকটি গান গাইল শৈবাল। একসময় তাকে কাঁধে করে নিয়ে নাচতে  শুরু করল দর্শকরা। দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুলতান সাহেব। এ যুগের ছেলেমেয়েরা আপন সুর কাঁধে তুলে নিয়েছে দেখে তার চোখ থেকে আনন্দ অশ্র“ ঝরতে  থাকে। 


বাসায় ফিরে এসে নিজের রুমে যান সুলতান। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গাইতে থাকেন মন মনরে আমার তুই ফেলে এসেছিস তারে। আজ তার মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। বয়সটা মনে হচ্ছে অনেক কমে গেছে। মনটা ও ভীষণ চাঙ্গা। এই অদ্ভুত ভালো লাগার কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করেন তিনি। শৈবাল ভালো করেছে এটা একটা উল্লেখযোগ্য কারণ। তার  মনে হয় আজকের এই ভালো লাগার আরো বিশেষ কোনো কারণ আছে। কিন্তু সেটা কি! কিছুতেই মনে করতে পারে না সুলতান। সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। অজান্তে টেনে নেন স্মৃতিসঙ্গি পুরাতন একটি ডায়রি। পাতা উল্টাতে থাকে। হঠাৎ এক জাগায় এসে তার চোখ আটকে। কালো হরফে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে- আজ বসন্ত উৎসব। আমাদের প্রথম দেখার দিন। বাকি লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। অজান্তেই তার চোখ থেকে অশ্র“ ঝরতে থাকে। সেই কতকাল আগে তার ডায়রিতে নীলিমা লিখেছিল এই কথা। এমনই এক বসন্ত দিনে তার জীবনে এসেছিল নীলিমা। আবার এমনই এক বসন্ত দিনে জীবন থেকে ঝরে পড়েছিল সে। যেন একই দিনে আপন সুর আর আপন মানুষ ফিরে পেলো সুলতান। 

 

উপরে