শিরোনাম
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় হাইতির চেয়ে কম ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র জয় দিয়ে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শুরু বাংলাদেশের হাঙ্গেরিকে ইউরোপীয় আদালতের ২০০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা পদত্যাগ করলেন মোদী, শপথ নিতে পারেন শনিবার সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড যে গ্রামের বাসিন্দারা প্লেনে চড়েই অফিস-বাজারে যান! টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ইমদাদুল হক মিলন ও মাহবুব ময়ূখ রিশাদ বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর মিয়ানমারের সিত্তে শহরের আশপাশের গ্রাম খালি করার নির্দেশ নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 12 December, 2018 00:19
গল্প

সমুদ্র সমুজ্জ্বল ।। সৈয়দ মাহমুদ

 সমুদ্র সমুজ্জ্বল ।। সৈয়দ মাহমুদ

দ্য হাই লাইন-নিউ ইয়র্ক সিটির লোয়ার ম্যানহাটানের পশ্চিম প্রান্তে একটা পাবলিক পার্ক। সিটি কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালে একটি পরিত্যক্ত এলিভেটেড রেলওয়ে ট্র্যাককে এই পার্কে রূপান্তর করেছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এই পার্কটিতে বেড়াতে আসে। মিটপাকিং, চেলসি এবং গ্রীনিচ ভিলেজ এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের আনাগোনাটা এখানে বেশী হলেও মূলত নিউইয়র্কার যারা শহুরে গুঞ্জন কিংবা রাস্তার হল্লা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে চান তাদের জন্য একটু উচ্চতায় এই পার্ক একটি আদর্শ জায়গা। কর্তৃপক্ষ এখানে নানা রকম আকর্ষণীয় সোশ্যাল ইভেন্ট আয়োজন করে থাকেন, যেমন লাইভ মিউজিক পাফর্মেন্স, ডান্স পার্টি, স্পোকেন ওয়ার্ড ফেস্টিভ্যাল, ওপেন এয়ার আর্ট এক্সিবিশন ইত্যাদি। সামারে নানা রকম খাবারের দোকান বসে যায়। সে সময়টা রোমান্টিক কাপলদের জন্য আদর্শ সময়। কেউ কেউ অবশ্য আসেন প্রশস্ত সবুজ প্রান্তর অথবা হাডসন রিভার ভিউ উপভোগ করতে। হাডসন নদীর অপর প্রান্তে সূর্যটা যখন ডুবু ডুবু তখন এখানে দাঁড়িয়ে পুরো সিটিটাকে অনন্য এক রূপে দুচোখ ভরে আবিস্কার করে বাঙ্গালী নারী তটিনী, বাবা যার নাম রেখেছিলেন সুখী।

 

এইটিন্থ স্ট্রীট ধরে হাঁটতে থাকা কাজ ফেরত তটিনী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। আজ হঠাৎ করেই কেন তার মনে হলো এখানে আসতে! একেবারেই কোলাহল শূন্য, যেন সমস্ত হৈ হল্লা পায়ের নীচে ফেলে মুক্ত আকাশের নীচে উঠে আসা। এত বিশাল সবুজের সমারোহ! হাটতে হাটতে যেখানে হাডসন নদীকে আতি কাছ থেকে পাওয়া যায় সেখানটায় চলে আসে তটিনী। গোধুলী বেলায় ম্রিয়মাণ সূর্যটা ঠিক নদীর উপর আলতো করে নরম কিরণ ঢেলে দিচ্ছে, যার প্রতিফলিত রশ্মি তীরের দৃশ্যাবলীকে আরো চমৎকার মোহময় করে তুলেছে। কি অপূর্ব! তটিনী অকস্মাৎ পঁচিশ বছর আগে ফিরে যায়। তখন তাকে সবাই সুখী নামেই ডাকত, বয়স কতই আর হবে বারো কিংবা একটু বেশী। জেলা শহরে বেড়ে ওঠা তাদের পরিবার মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে যেত। দাদু বাড়ীর রাস্তায় ছোট্ট একটা নদী নাকি শাখা নদী যেন ছিল। নদী পেরুবার ব্রীজ ছিলনা, বাঁশের সাঁকো বেয়ে পার হতে হতো। এ রকমই এক বিকেলে সেই সাঁকোর উপর বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ঠিক এ রকম একটা দৃশ্যইতো সে দেখেছিল সেদিন! তটিনী স্মৃতি কাতর হয়ে ওঠে। সেদিন সূর্যটা বাঁশ বাগানের উপর থেকে তার শরীরে আর নদীর কালচে সবুজ রঙ্গা পানিতে কিরণ ঢেলেছিল। আজ এত দিন পরে সে কথা মনে হতেই তটিনীর মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল যেন। হায়রে স্মৃতিময় দূরন্ত শৈশব! এই হাই লাইন পার্কে এসে তটিনীকে আজ নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসলো। কেন যেন সব পুরাতন স্মৃতি মনে পড়ছে, ছেলে বেলা থেকে বেড়ে ওঠা, বিয়ে, সংসার, একাকীত্ব!

 

বিয়ের পর রাতুলের সাথে সেই যে সে নিউইয়র্কে চলে এলো, তার পর হাতে গোনা ক’বার মাত্র দেশে গেছে কিন্তু দাদু বাড়ী পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। আচ্ছা, সেই সাঁকোটা আজও কি নদীর উপর এমন করে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ পারাপার করে! কিংবা বাড়ীর সামনের সেই পুকুটায় কি এখনো সেই পদ্মফুল গুলো ফুটে থাকে! সেই শান বাঁধানো ঘাটে বসে আর কি কখনো সিঁটি দিয়ে চলে যাওয়া রেলগাড়ীটা দেখা হবে না! এ সব ভাবতে ভাবতে এক রকম শূন্যতা অনুভব করে তটিনী। একটা রেলিংএর মতো দন্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাডসনের পানির উপর নজর রেখে সে ভেবে চলে। রাতুল কোনদিন তাকে এখানে আনেনি কেন?

 

একটা সময় রাতুল তাকে নিয়ে কতইনা আদিখ্যেতা করেছে! একবার লিংকন সেন্টার থিয়েটারে ব্যালে দেখে এসে বাসায় তাকে নিয়ে ব্যালে নৃত্যে মেতে উঠল, তাদের মেয়েটা দেখে কি খিললিল হাসি! নায়াগ্রা ফলস্ দেখতে গিয়ে তেমনি এত সব মানুষের সামনে প্রকাশ্যে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। কোন উইকেন্ডেই ঘরে থাকা হতো না, আর কোথাও না হোক অন্তত টাইমস স্কোয়ার অথবা ব্রুকলিন ব্রীজ ধরে হাটতে থাকা কিংবা সেন্ট্রাল পার্কের বাইক অথবা পেডিক্যাব ট্যুর – এই সব ছিল নিত্যকার ঘটনা। একটা সময় টাইমস স্কোয়ারের তীব্র আলোয় পণ্যের বিল বোর্ড, ওপেন এয়ার কনসার্টের চিৎকার, স্মার্ট তরুন-তরুনীদের পদচারণা মুখর পরিবেশে মিশে যেতে ভালই লেগেছিল ওর। নিজেকে অনেক স্মার্ট আর আকর্ষনীয় করে তুলেছিল। এমনিতেই তটিনী যথেষ্ট সুন্দর তা সে জানে। পথ চলতে এখনো যুবকেরা তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার একান্ত আপন মানুষটার কি হলো! আজ কাল রাতুল তার দিকে যেন ভাল করে তাকায়না। যদি বলা হয় চলো মেয়েটাকে নিয়ে চায়না টাউনে ঘুরে আসি, তাহলে সে যাবে। মেয়েটা চায়না টাউনের বোবা টি আর মিঃ বিং এর ষ্ট্রীট ফুড খেতে ভাল বাসে। বলা মাত্রই সে নিয়ে যাবে টাইমস স্কোয়ারে লিটিল ইটালী, রক পিৎজা, বার্গার বক্স কিংবা ইষ্ট ভিলেজে খেতে, এ ব্যাপারে তার কোন কার্পন্য নেই। কিন্তু নিজে থেকে কখনোই বলবেনা চলো বাইরে যাই। আগে তো এমন ছিল না রাতুল! এখন তটিনীর দিকে একটু বিশেষ দৃষ্টিতেও তাকায় না। শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারটাও যেন ক্যাজুয়াল-নিরুত্তাপ। রাতের পর রাত স্পর্শহীনও কেটে যায় অথচ কলহ বিবাদ কিছু নেই।

 

হঠাৎ তটিনীর ভাবনায় ছেদ পড়ে। গিটারে রবীন্দ্র সংগীতের সুরঃ আমার সকল দুখের প্রদীপ…জ্বেলে দিবস..গেলে করবো নিবেদন। গিটারের সুরে সুরে তটিনীর মন আরো উদাস হয়ে যায়, জমাট বাঁধা কষ্ট গুলো বুকের ভেতর উত্তাল ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত হতে থাকে। সুখী নামের তটিনী আজ একাকীত্বের যন্ত্রণা ভোগ করছে! এমনতো হবার কথা ছিল না। তবে কি সে ফুরিয়ে গেল এত দ্রুত! তার মন, হৃদয়, তার সৌন্দর্য- সব কিছু কি এত তুচ্ছ হয়ে গেল রাতুলের কাছে! এত প্রাণোচ্ছ্বল জীবন তাদের কেন এমন হলো! রাতুল তো এমন নয়। এই নির্লিপ্ততার অর্থ কি? কেন সে তটিনীর কাছেও কিছু জানতে চায়না! বিয়ের পর একদিন ওর মন খারাপ দেখে এই রাতুলই তো তাকে এক রকম জোর করে নিয়ে ছুটলো 43rd 44th Street Kiosks এ “Ice & Vice” আইসক্রিম খাওয়াতে। আইসক্রিম শেষ না হতেই বললো, আইসক্রিম আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এখন আমার আইস স্কেটিং করতে হবে। সোজা তাকে নিয়ে চললো রকফেলার সেন্টারের রিংকে স্কেটিং করতে। সেটি শেষ হতে না হতেই তার আবার আইসক্রিমের নেশায় পেয়ে বসলো, আবার ফেরত আসা আইসক্রিম খেতে। খেতে খেতে অনুনয়ের সুরে বললো, চলোনা টাউন হলে যাই, একটা মিউজিক্যাল শো হচ্ছে। সেই উচ্ছ্বল রাতুল আজ কি করে এতটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেল! তটিনীর আকাশসম হাহাকারের সাথে গিটারের সুরের কান্না একাকার হয়ে বরফ গলা নদীর মতো গন্ড বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। তার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীতের সুর তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। কত কাল এমন মুক্তমনে কাঁদতেও পারেনা সে! তটিনী ভাবে সেও কি এই নিঃসঙ্গতার জন্য কিছুটা দায়ী নয়! কেন সে নিজেও রাতুলকে কিছু বলেনা, আগ বাড়িয়ে স্পর্শ করেনা, একটু ভিন্ন চোখে তাকায়না! এই মান অভিমান আর ইগো নিয়ে কতকাল পথ চলা যায়!

 

বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হতে চললো। সূর্যটা লাল হয়ে নদীর অপর প্রান্তে প্রায় ডুবু ডুবু। সেই বিদায়ী রঙয়ের ছটায় আকাশটা কেমন মায়াবী হয়ে গেল। কষ্টের পাহাড়টা মনে হলো কিছুটা হালকা হয়েছে। ধীরে ধীরে সে ফিরে চাইল। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে এক যুবক গিটার বাজাচ্ছে। তটিনী ভাল করে দেখার চেষ্টা করে। বয়স অনুমান করা যায় চল্লিশোর্ধ, রোদে পোড়া তামাটে রং, গায়ে টি-শার্ট আর জিন্স, চুল গুলো একটু খানি ঝুটি করে রেখেছে, চশমাটা টি-শার্টের গলায় ঝুলছে। গভীর আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে বাজাচ্ছে সে। তটিনী ভাবে এই চমৎকার গিটারিস্ট যুবকের মনেও নিশ্চয়ই কোনো কষ্ট আছে, নাহলে এত গভীর মমতায় সুর তুলে যাওয়া কি সম্ভব!

 

কিছুক্ষণ পর তার কানে ভেসে আসে গিটারিস্টের কন্ঠস্বরঃ

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;

 

থেমে গেল কেন সে! তটিনীর হৃদয়ের সকল অস্থিরতা, মনের চঞ্চলতা কেটে যায়, স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবে এর পর তো পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বনলতা সেনই বলবে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ যাবে নাকি সে, গিয়ে বলবে, এতোদিন কোথায় ছিলেন? লজ্জা এবং সংকোচ দুটোই হচ্ছে কিন্তু তীব্র টান অনুভব করছে সে। কিছু কি মনে করবে ভদ্রলোক-তেমনটা মনেও হচ্ছে না। হঠাৎ করে তার ভিতরে এক নূতন প্রাণের সঞ্চার হয়। সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে তটিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, কম্পিত কন্ঠে বলেই ফেলে, এতদিন কোথায় ছিলেন?

 

যুবক স্মিত হাস্যে উত্তর দেয়, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে; সেখানে ছিলাম আমি। মৃদু হেসে আবার বলে, এটিই আমার আপন নিবাস, আগে কখনো আসেননি বুঝি?

 

তটিনী যুবকের গভীর কালো চোখ জোড়ায় দৃষ্টি রেখে উত্তর দেয়, না, আগে কখনো এখানে আসা হয়ে ওঠেনি। আপনার গিটারের সুর আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। পরিচিত হতে এলাম, আমি সুখী, বাবার দেয়া নামটাই বলে ফেলে সে।

 

আসলেই কি তাই? যুবকের প্রশ্নটা তটিনীর বুঝতে একটু খানি সময় লাগে, নাম সুখী হলেও সে কি আসলে সুখী! বাবা তাকে সর্বান্তকরণে সুখী দেখতে চেয়েছিলেন বলেই কি এই নাম করণ! হয়ত তাই। কিন্তু তটিনী বা সুখী কি আসলে সুখী হতে পেরেছে? উল্টো সকলকে সুখী করতে সেই তো প্রনান্ত চেষ্টা করেছে। ভাই-বোন, নিকটাত্মীয়, মেয়ে, স্বামী রাতুল, সবার জন্যই তো সে নিবেদিত প্রাণ। তার কাছ থেকে কেউ কি কখনো নিরাশ হয়ে ফিরেছে, এমন নজির তো একটিও নেই। কিন্তু সে কিসে সুখী তা কি কেউ কোন দিন জানতে চেয়েছে! তার ছোট ছোট চাওয়া গুলোই তো কেউ বুঝতে চায়নি। অন্য সবার কথা বাদই দেয়া যাক। রাতুলের কথাই যদি বলা হয়, এই যে তটিনী সারাদিন সংসারের জন্য খেটে আবার কাজে যাচ্ছে, ক্লান্তি অবসাদ, মন খারাপ কতো কি হতে পারে। কখনো তো রাতুল জানতে চায় না, কখনো তো এক কাপ কফি বানিয়ে এনে তার হাতে দেয় না। ছুটির দিনে যদি তটিনী কখনো বলেছে আজ রান্না করতে ইচ্ছে করছে না অমনি বলে বসবে চলো তাহলে বাইরে খেয়ে আসি, কেন বাবা একটা বেলা হাত পুড়িয়ে রান্না করে তাকে খাওয়ানো যায় না! আজীবন তো সে এই কাজটা একাই করে এলো।

 

তটিনী যুবকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা, বরং বলে, বাবা আদর করে রেখেছিলেন, বিয়ের পরে নামটা পাল্টে রাখা হয়েছে তটিনী।

 

যুবকের প্রশ্ন, আপনি তা নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন?

 

তটিনী বলে, অন্যের ভাল লাগার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। তার নামটা ওদের কাছে সেকেলে মনে হয়েছিল বলে বিয়ের পর নূতন নাম রাখা হয়েছে। তটিনী কোমল হৃদয়ের মেয়ে তাই এটি নিয়ে কোন রকম উচ্চ বাচ্য করেনি, বরং মেনে নিয়ে সকলকে সুখী করতে চেয়েছে।

 

যুবক বলে, বাঙ্গালী নারী বলে কথা, তটিনী নামটাও চমৎকার! মৃদুস্রোতা নাকি খরস্রোতা?

 

তটিনী যুবকের কথায় বেশ আন্দোলিত হয়ে বলে, কখনো খরস্রোতা কখনো শুকনো বালির চরা……আপনার নামটা জানতে পারি?

যুবক বলে, শত তটিনীর স্রোত যেখানে মিশে যায়।

তটিনী জানতে চায়-সাগর?

যুবক বলে, না সমুদ্র-সমুদ্র সমুজ্জ্বল।

তটিনীকে প্রগল্ভতায় পেয়ে বসে। সে বলে, বাহ, চমৎকার নাম! তা কত তটিনীর জল সে সমুদ্রে মিশেছে?

সমুদ্র বলে, এক তটিনীর জলেই ভরে গেছে সমুদ্রের গহ্বর, কিন্তু সে জল পান করা হলো না। এই বলে সে গিটারটায় সুর তোলেঃ

মায়বন বিহারিনী হরিণী

গহন স্বপন সঞ্চারিনী

কেন তারে ধরিবারে

করি পন অকারণ

মায়াবন বিহারিনী …..

তটিনী বুঝে যায় এর অর্থ কি! সমুদ্রের দিকে গভীর মমতার দৃষ্টিতে তাকায়। সমুদ্র উদাস ভঙ্গিতে বাজিয়ে চলেঃ

থাক থাক নিজ মনে দূরেতে

আমি শুধু বাসরীর সুরেতে

পরশ করিব ওর প্রাণ মন অকারণ

মায়াবন বিহারিনী ……

সমুদ্র থেমে গেলে তটিনী জানতে চায়-দেখা হয় না?

সমুদ্র আবার বাজায়ঃ

দূর হতে আমি তারে সাধিব

গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব

বাঁধন বিহীন সেই যে বাঁধন অকারণ

মায়াবন বিহারিনী …..

 

গিটার থামিয়ে সমুদ্র উদাস দৃষ্টিতে সান্ধ্য আকাশের পানে তাকায়। তার গভীর কালো চোখে কি যেন এক মায়া যা তটিনীকে তীব্র আকর্ষণ করে। সে ভাবে, সেই হরিনীকে সমুদ্র কেন আকর্ষণ করতে পারল না, ক্ষনিকের সান্নিধ্যেই তটিনীকে তো পারছে!

 

তটিনী বলে, দুঃখিত, আমি মনে হয় অজান্তেই আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।

সমুদ্র বলে, একদমই না, আমার মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কোনো কষ্টই আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।

 

তটিনী বেশ অবাক হয়ে অত্যন্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সমুদ্রের পানে তাকিয়ে থাকে।

 

সমুদ্র বলে, অবাক হচ্ছেন কেন? সুখ জিনিসটা তো আপেক্ষিক। যার যেটুকু আছে তা নিয়েই সুখী হওয়া যায়, সুখটা হচ্ছে মনের চর্চার ব্যাপার। যখনই বেশী কিছু চাইবেন তখনই অপ্রাপ্তির প্রশ্ন আসবে আর সেই অপ্রাপ্তি থেকেই অসুখের যাতনা শুরু। আমি আমার এই গিটার, মুক্ত আকাশ আর একাকীত্ব সাথী করে বেশ সুখেই আছি।

 

তটিনী সমুদ্রের কথা গুলো আত্মস্থ করতে চেষ্টা করে। এভাবে তো সে কখনোই ভেবে দেখেনি। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সুখী থাকা যায়, সুখ একটা চর্চার ব্যাপার, অপ্রাপ্তি থেকেই অসুখের যাতনা শুরু। তবে কেন মনের ভিতরে এত হাহাকার, এত ক্ষরণ, কেন বেশী কিছু চাওয়া! এই চমৎকার বোহেমিয়ান নিঃসঙ্গ যুবক যদি কিছুই না পেয়ে নিজেকে সুখী ভাবতে পারে, তবে এত কিছু পেয়েও তটিনী কেন নিজেকে অসুখী ভাববে। সুখ তো একটা চর্চার ব্যাপার, যা কিছু আছে তাকে নিয়েই সুখী হতে হবে। এই মায়াবী সন্ধ্যার উপকন্ঠে সমুদ্রের মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে এসে তটিনী যেন নূতন অনুভবে নিজেকে আবিস্কার করলো। ওর ভাবনার জগৎটা পাল্টে গেল। ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করছে সে।

 

তটিনী সমুদ্রের কাছে বিদায় নিয়ে বলে, সুন্দর একটা সময় কাটালাম, ভাল থাকবেন, দেখা হবে আবার।

সমুদ্র বলে, অনেক ধন্যবাদ, আপনিও ভাল থাকবেন, নিশ্চয়ই দেখা হবে।

তটিনী এখন খরস্রোতা, তার বুকে বান ডেকেছে, বেশ চঞ্চলতা নিয়েই সে আপন ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কানে ভেসে আসে গিটারের সুরঃ

রেখ না আর বেধোনা আর

কুলের কাছাকাছি

আমি ডুবতে রাজি আছি

আমি ডুবতে রাজি আছি

তোমার খোলা হাওয়া …..

ঝড়কে আমি করবো মিতে 

ডরবো না তার ভ্রূকুটিতে

দাও ছেড়ে দাও

ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি

আমি ডুবতে রাজি আছি 

আমি ডুবতে রাজি আছি

তোমার খোলা হাওয়া…

 

চঞ্চলা হরিনীর মতো যেন লাফিয়ে লাফিয়ে তটিনী বাড়ী ফিরলো। হঠাৎ করে মনটা এত চনমনে হয়ে ওঠায় বেশ ভাল লাগছে তার, সেই সাথে অবাকও হচ্ছে। রাতুল তখনো ফেরেনি। সে সোজা শাওয়ার নিতে যায়, দীর্ঘ একটা ক্লান্তি অবসাদ ভোলা স্নান তার চাই। জন্মদিনে রাতুলের কাছে পাওয়া ম্যাজেন্টা শাড়ীটা পড়ে হালকা প্রসাধন করে সে। টিপ দেয়ায় অভ্যস্ত না হলেও শাড়ীর সাথে ম্যাচিং টিপ দিয়ে নেয়। আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয় তটিনী। এত লাবণ্যময় লাগছে কেন তাকে! মেয়েটা এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, বলে, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে মা। ডোর বেলের শব্দে দরজা খুলে দিয়ে তটিনী ইগো-অভিমান ভুলে সরাসরি রাতুলের চোখে মায়াবী চোখে তাকায়। রাতুল চোখ ফেরাতে পারেনা, তটিনীর দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে কিছুটা সময়।

ডিনার সেরে কফি বানিয়ে এনে রাতুল কে নিয়ে মুভি দেখতে বসে তটিনী। মেয়েটা ঘুমোতে গেলে রাতুল তড়িৎ এসে তটিনীকে জড়িয়ে ধরে গোটা কয়েক তীব্র চুম্বন আঁকে। অনেক দিন পর তটিনী রাতুলকে বিছানায় আগের ভূমিকায় খুঁজে পায়, নিজেও উজাড় করে দিতে সচেষ্ট থাকে। একটু খানি ক্লান্তির ঘুমের পর তটিনী জেগে যায়। ও শুনতে পায় সমুদ্রের গিটারের সুরঃ

রেখ না আর বেধোঁনা আর

কুলের কাছাকাছি

আমি ডুবতে রাজি আছি

আমি ডুবতে রাজি আছি। ।

 

তটিনীর মুখের অবয়ব আরক্ত হয়ে ওঠে। কিসের যেন চঞ্চলতা, তৃষ্ণা অনুভব করে। সে দেখে রাতুল তার দিকে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তটিনী একটু যেন লজ্জা পেল। রাতুল দুষ্টুমীর চোখে তাকিয়ে বলে, Another round? তটিনী উত্তর না দিয়েই রাতুলের বুকের উপর লাফিয়ে পড়ে।

 

পর পর বেশ ক’দিন তটিনী দ্য হাই লাইন পার্কে গেল কিন্তু সমুদ্রকে সে আর খুঁজে পেল না। ঠিক সেই জায়গাটায় সে অপেক্ষা করে বসে থাকে, কিন্তু সমুদ্র আসেনা। যে সমুদ্র তাকে উচ্ছ্বল ঝর্ণা করে তুললো, খরস্রোতা তটিনী বানিয়ে দিল সে কেন উধাও হলো! তটিনীর মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবে পায়না কোথায় গেলে তার দেখা মিলবে। সাব ওয়েতে অনেক গিটার পারফর্মার দেখা যায়। কিন্তু সমুদ্র সেখানে বসে গিটার বাজানোর মানুষ বলে মনে হয় না। তবুও মাঝে মাঝে তটিনী সাবওয়েতে নজর বুলিয়ে আসে। সমুদ্রের সাথে যায় এমন জায়গা গুলো কি হতে পারে, পাবলিক লাইব্রেরীর পিছনটায় ব্রায়ান্ট পার্ক কিংবা ব্রডওয়ে থিয়েটার ডিষ্ট্রিক্ট – এই সব জায়গাতেও সমুদ্রকে পাওয়া গেল না। সেই এক সন্ধ্যেবেলার মধুর সান্নিধ্য তটিনী কিছুতেই আর ভুলতে পারছে না। কেন যেন সমুদ্রের গিটারের সুর তাকে তীব্র আকর্ষণে টেনে আনে এখানেই বার বার যেখানে দেখা হয়েছিল। ইতোমধ্যে প্রথম কিংবা শেষ দেখার মাস পেরিয়ে গেছে। শেষ দেখা-এমনটা সে ভাবতে চায় না।  এক রকম শূন্যতায় ভাসতে থাকে তটিনী-তবে কি আর দেখা হবে না! সে তো বলেছিল নিশ্চয়ই দেখা হবে। তাহলে কেন এমন হলো! এরই মাঝে একদিন তটিনী বুঝতে পারে এবং নিশ্চিত হয়ে যায় তার অভ্যন্তরে বেড়ে উঠছে এক নূতন প্রাণ, সে ভীষণ পুলকিত এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ভেবে নেয় এবার তার ছেলে সন্তান হবে, আর তার নাম রাখবে সমুদ্র সমুজ্জ্বল।

উপরে